Original post: https://www.sahityacafe.com/?p=13411 July 25, 2020
[তরুণ চিত্রশিল্পী সোহেল প্রাণন দুই হাজার সতেরো সালে কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। থেমে যায় তাঁর আঁকা-আঁকি, ভর্তি হন হাসপাতালে। শুধু তাই নয়, থেমে যায় তাঁর এবং সহধর্মিনী ও শিল্পী সান্ত্বনা শাহরিণের যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা বর্ণিকার সব কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের নামকরা চারটি হাসপাতাল ঘুরে জানতে পারেন তাঁর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডাইলোসিস ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। দরকার হয়ে পড়লো লক্ষ লক্ষ টাকার। সকলের কাছে আর্থিক আবেদন জানানো হল। শুরু হল অপারেশন প্রস্তুতির সাথে চলছে ঔষধি চিকিৎসার খোঁজ। অবশেষে খোঁজ পেলেন থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদে। জানতে পারলেন এই রোগের ঔষধি চিকিৎসা আছে। শুরু হল চিকিৎসা, ওষুধ ঠিকঠাক কাজ করতেও শুরু করলো। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসাতে এখনো সুস্থ আছেন তিনি। আবার ছবি আঁকার জগতে ফিরে আসতে পেরেছেন, বর্ণিকাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
দেশে এখন লক্ষ কোটি মানুষ অসুস্থ হয় শুধুই কৃত্রিম জীবন ব্যবস্থার কারণে। মানুষের খাদ্যাভাস, জীবনযাপনের ধরণ পরিবর্তন না হলে মানুষকে বাঁচানো কঠিন। কর্মের ধরণ পরিবর্তন হবে, ক্ষুদ্র কৃষি ভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে নইলে বিশ্ব মানব সম্পদ ও মানুষের তৈরি সভ্যতা বরাবরের মতো নুয়ে পড়বে ঢালে।
এসব বিষয় নিয়ে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনায় স্বপ্নমগ্নতা ও পরিশ্রমে কীভাবে এগিয়ে চলবে বর্ণিকা তা নিয়ে লিখছেন শিল্পী সোহেল প্রাণন । তুলে ধরেছেন বর্ণিকার চিত্রশিল্পের সাথে কৃষি,হাস মুরগী, ছায়াঘেরা পরিবেশ, স্বাস্থ্যচিন্তা, শিশুশিক্ষা নিয়ে গড়ে ওঠা টোটাল আর্ট ধারণা – সাহিত্য ক্যাফে]
শাশ্বত জীবন সাধনার ধ্যান আশ্রয়
প্রত্যেক মানুষের দার্শনিক মত বিশ্বাসের রূপ ভিন্ন, প্রার্থনাগারও ভিন্ন। তেমনি আঁকিয়েদের আত্ম চৈতন্যবোধ ও জীবন ব্যবস্থার পক্ষে শুদ্ধ সাধনার জন্য দরকার প্রার্থনাগার। “বর্ণিকা” ধ্যান আশ্রয় তেমন এক আশ্রয় গৃহ। বর্ণিকার এই নিরীক্ষণ আগামী দিনের বৈজ্ঞানিক নকশার হিসেবে শিল্প কৃষির নির্দেশিকা।
ভৌগলিক সিমানা বিচারে ঋতু উপর পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ হতে হয়। সমাজের মানুষের চাহিদা আছে, উৎপাদন নেই। আছে উচ্চাকাঙ্খী জীবন ব্যবস্থার প্রতি লোভ। ফলে বৈষম্য মাত্রাধিক ভাবে বেড়ে চলেছে। দরকার কর্মসংস্থানের কিন্তু কাজের ক্ষেত্র তৈরি নেই, আছে দুশ্চিন্তার বোঝা। যে,যে বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জন করেছেন হয়তো কাজ মিলছে ভিন্ন কোন বিষয়ে, এমন পরিস্থিতিতে কর্মের ধরণও পালটে ফেলতে হচ্ছে। আসল কথা কোন কিছুতেই সমাধান মিলবেনা, কারণ একটাই অতিরিক্ত জনসংখ্যা।
কৃষি প্রধান দেশ হলেও কৃষকের পদ হচ্ছে শূন্য। কৃষকের ক্ষমতা অন্যের দখলে। হচ্ছেনা কৃষির সন্মান রক্ষা, অথচ ধান বিক্রির টাকায় নিজেকে গড়ে-পিঠে হয়েছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, নেতা আরও কতো কি! সেই কৃষি রক্ষায় নেই কোন অবদান । এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে বর্ণিকা হাতে নিয়েছে বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনা।
দেশ ভাগে নাড়ি ছেড়া শিশুটির আর্তনাদ বেশী দিনের পুরনো গল্প নয়, কিন্তু আজও মগজের রন্ধে সে বেদনা বয়ে বেড়াতে হয়। এটা বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জন্য বড় আঘাত।
এই উপমহাদেশে নানা জাতির বাস। প্রত্যেক জাতির বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আছে। বাঙালি জাতিরও তেমন সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে। সেই সংস্কৃতি ক্রমশ পালটে যাচ্ছে বহুমাত্রিক মিশ্র সংস্কৃতির কারণে। ফলে মৌলিক সংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হারাচ্ছে তার মূল সৌন্দর্য। শিক্ষা ব্যবস্থার কোন ঠিকানা হচ্ছেনা। রাষ্ট্রে দার্শনিক মতের এমন অমিল আছে বলেই কাঠামো নড়বড়ে। তাই মানুষ মানুষ একক স্বার্থবাদী লোভী আচরণ করে। যে কারণে স্বাধীন পতাকা পেয়েও কূলের সন্ধান মিলছেনা। বহু মিশ্রিত গোত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ ও মনস্তাত্ত্বিক গঠন অপক্ক বলেই আদিম বর্বরতার ছাপ এখানে প্রকৃষ্ট। তাই নিজের খাবারে মানুষ বিষ মিশিয়ে খাচ্ছে, অধিক মুনাফার লোভে বিক্রি হয়ে যা্চছে। মন, আবেগ, শরীর, ধর্ম, বিশ্বাস, রাজনীতি পণ্যে পরিণত হচ্ছে। ফলত ব্যয়িত জীবনে বিষাক্ত মৃত্যুকূপে পতিত জিবনব্যবস্থার কুফল। ব্যাধিগ্রস্ত বিপন্ন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অথচ নানা দার্শনিকের জন্ম এই মাটিতে তাঁদের দর্শনের নির্দেশনায় চর্চা হতে পারতো এদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ। হতে পারতো দেশের উপযোগী করে নীতিমালা তৈরি। অথচ কেমন হাত গুটিয়ে বসে থাকা অবস্থা। এখন শুধুই কৃষ্টির জয়গানে নিজেদের নিবেদন অস্তিত্ব রক্ষা এবং অস্তিত্ব রক্ষা।
বর্ণিকা
ভারত শিল্পের তত্ত্ব বুঝতে পাঠ করতে হয় শিল্পের ষড়ঙ্গ। সেই ছয়টি অঙ্গের একটি অঙ্গ হচ্ছে “বর্ণিকা ভঙ্গ”। সেখান থেকে নেওয়া “বর্ণিকা” নামটি। বর্ণিকার যাত্রা শুরু ঢাকাতে, দুই হাজার দশ সালে। দীর্ঘ দশ বছরে বর্ণিকা তার নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছে।
বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পীদের উপস্থিতির জায়গা বর্ণিকা। বর্ণিকা আর্ট স্টুডিওর স্থায়ী ঠিকানা যশোর। বর্তমানে বর্ণিকার পেইন্টিং ও ছাপচিত্র স্টুডিও সক্রিয়।
অরণ্যে জীবসত্তা
ধ্যানস্থ প্রাকৃতি নৈঃশব্দ বরণে প্রয়োজন ইকো ভারসাম্য। তবেই আত্ম নিমগ্ন প্রাণের পরিপূর্ণতা লাভ হবে। এমন জীবনচর্যাই হবে শিল্পের শুদ্ধ সুর। যেখানে প্রকৃতি ফিরে পাবে জীবসত্তা, মাটি ফিরে পাবে মাতৃত্বতা।
এমন চিন্তা থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে জৈব কৃষি সাধনা। উৎপাদন মুখী আয়ের পথ হবে ভেবে দুই হাজার ষোল সালে শুরু হয় অরগানিক পদ্ধতিতে আবাদ। প্রতি দিনের অনুশীলনে প্রকৃতির পক্ষে এক জীবন ব্যবস্থা সৃষ্টির লক্ষে চলছে এই কাজ । একে একে যুক্ত হচ্ছে মাছ ও দেশি মুরগি। মুরগির আয়োজনটি “কুঁকড়ো ক্লাব” নামে পরিচিত। এমন নামকরণের উদ্দেশ্য খেলার ছলে তা থেকে যেন আয়ের উৎস তৈরি হয়। এমন উৎপাদনে বর্ণিকার আয়ের পথ হবে।
বর্ণিকার ঋতু ভিত্তিক ধারণাপত্র রঙিন গল্পে সাজানো। তাই বর্ণিকার উঠোনে ফুল উৎসব, ফল উৎসব, উঠোন চিত্র, মাটি খেলা, দেওয়াল চিত্র, অরণ্যে জীবসত্তা, কুঁকড়ো ক্লাব ইত্যাদি শিরোনামে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বর্ণিকার বিশ্বাস এমন চর্চা নিজেদের আত্মিক শান্তি ও পরিবেশের সুরক্ষা দেবে। শিল্পের সাথে জীবনের আরদ্ধ সাধন হবে। বেশ কষ্টসাধ্য এবং বিপদের আশঙ্কা থাকলেও আনন্দে তা উত্তরণ আবশ্যক। নইলে বৃথা হবে সব।
নিথর ঘনছায়া
বিশ্ব উল্লম্ব সভ্যতা প্রকৃতির পক্ষের আচরণ করেনা। শুধু প্রকৃতি হত্যার কাজে মেতে থাকে। সেখান থেকে প্রকৃতির পরাণ পাখীরা লুপ্ত হয়ে যায়। সে কারণে হয়তো আমাদের গুচ্ছ গুল্মলতাতে ছোট পাখীরা বাস করে। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকিরা পীতবর্ণ আলো দেয়। ফুলজ,ফলজ,বনজ, ঔষধি গাছের ঝোপে চলে গুঞ্জন। ঋতু ভিত্তিক প্রাকৃতিক চক্র গাছে আসে ফল। চাহিদা পূরণে পাখীরা আগে পরে মানুষ খায় ।
এমন পরিবেশের সাথে মানব দেহকোষের নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে নানা রকমেরবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। প্রাণ থেকে প্রাণের রসায়নে অপরিহার্য সম্পর্ক । তাই প্রাকৃতিক চক্র সচল করতে দুটি ঘন অরণ্য বেষ্টিত ইকো চেম্বার তৈরি করেছে বর্ণিকা,যেখানে মানুষের প্রবেশ নিষেধ।মানুষ যেখানে হাটে সেখানে বিরাণ ভূমি হয়ে যায়। এখন এই স্থানটিতে খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব প্রাণের উপস্থিতি ঘটছে। বুনো অর্কিড, কিটপতঙ্গ, নিথর ঘনছায়া যা মানব প্রাণের অতি আপন।
পরদেশী গাছের উপস্থিতি কম, প্রকৃত মাটির অধিকারে যে সব গাছ জন্মাবে শুধু সেই গাছের স্থান দেওয়ার চেষ্টা ক রা হয়েছে। এ যেন এক শিল্পী জীবনের সাথে ক্ষুদ্র কৃষির ব্রত।
কলা কথা
আঁকা গড়ার ভাবানাটা পরিবেশের ফসল হলে তবেইনা পাগলামিটা জমে ওঠে। শিল্পের অনুষঙ্গ যদি ভেজা পাতার নিবিড় প্রেম থেকে না হয় তবে কিসের ঈশ্বর প্রেম! হয়তো শিল্পী ঈশ্বর পুত্র প্রকৃতি তার প্রতিপালক। আলো, বাতাস, জলে নেচে নেচে যে খেলে বেড়ায়। সেই পূর্ণ প্রেমের কাঙাল হতে এসেছে জগত কুলে।
শিল্প সব সময় পূঁজিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শহর কেন্দ্রিক এই পূঁজির রাজনীতি সারা পৃথিবীতে চলে। তবে এদেশে শিল্পের গণ্ডিটা বড্ড ছোট করে রাখা এবং পথনির্দেশনা অগভীর বিভ্রান্তকর। মুক্ত নয় শিল্পের ধারা। শিল্পের প্রতিষ্ঠান শিল্পের বিদ্যাপীঠ শিল্পকে জঞ্জালে ঢেকে রেখেছে। এমন দাসত্বের কারণে শিল্প তার সুর হারাচ্ছে, শিল্পের বাতিঘর হারাচ্ছে ঠিকানা। গণ্ডি থেকে বের হবে সকল শিল্পীরা, মুক্ত হবে শিল্প, সুচিন্তায় বিকশিত হবে মৌলিক শিল্পের ধারা এমনটাই প্রত্যাশা।
একাডেমী কখনো শিল্পী তৈরি করেনা। শিল্পী সত্তা ঈশ্বর প্রদত্ত। তবে একাডেমীতে পড়েও শিল্পের সাধনা করা যায়, করা যায় দক্ষতা দিয়ে নানা ধরনের ব্যবহারিক শিল্পের কাজ। প্রতি বছর শত শত চারুকলা শিক্ষার্থী পাস করে বের হয় কিন্তু সে জানেনা কি করে রোজগার করতে হয়। তাদের নানা রঙের স্বপ্ন হারাতে বসে! অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীবন চালাতে করতে হয় অপ্রিয় কাজটি। দিন শেষে তাতে মেটেনা প্রাণের ক্ষুধা। এই ভাবে কতো শত প্রতিভার ভ্রূণ বিপথে পরিচালিত হয়। হতাশা গ্রস্থ না হয়ে এখনি সঠিক সময় ক্ষুদ্র কৃষিকে যুগোপযোগী করে ব্যবহার করবার। আর নয় নগর ও প্রকৃতির বৈরিতা, নাগরিক জীবনে প্রকৃতি বান্ধব আচরণ জরুরী, নইলে প্রকৃতি বিমূঢ় হবে, অতিমারী কেড়ে নেবে লক্ষ কোটি প্রাণ। তাই সভ্যতার পূর্ণতা লাভে প্রয়োজন হয় প্রকৃতিকে, মানুষের জীবনেও দরকার প্রেমের প্রকৃতিকে।
বর্ণিকার শিশু চিন্তা
শিল্পের উচ্চমার্গে শিশু শিক্ষার লক্ষে আনন্দে আঁকা গড়ার একটি মাত্র দিন আমরা উপহার স্বরূপ শিশুদের সঙ্গে যাপন করি।
শিশুর মনোজগৎ সৃজনশীল কাজের জন্য উৎকৃষ্ট। মুক্ত সরল প্রকাশ ভঙ্গি সাবলীল উপস্থাপন যা বড়দের দ্বিধা সংকট থেকে মুক্ত হতে ধারণা দেয়।গুহার আদিম চিত্রকলা থেকে যে জীবন গল্পের ধারণা আজও প্রবাহিত তাতে প্রার্থনা, আঁকা,গড়া, উৎপাদন ছাড়া কি বা আছে। দিনভর এই আনন্দ খেলাতে শিশুর শৈশব গড়ে দিতে পারে, গড়ে দিতে পারে জ্ঞান চর্চায় শাণিত শক্ত মজবুত ভিত।
যশোর
১৪/০৭/২০২০
সোহেল প্রাণন